পথের পাঁচালি বিভুতিভুষণের প্রথম বই। যেই বইটি লেখার পরই রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে গেছেন। যার মাধ্যমেই ইছামতি, আরণ্যক, চাঁদের পাহাড়ের মতো বই বিখ্যাত হয়ে এসেছে।
পথের পাঁচালি এমন একটি উপন্যাস যেটা পড়লে মনেই হবে না আপনি বই পড়ছেন। বরং আপনার মনে হবে এই তো অপু-দুর্গার মতো আপনিও বাঁশবনে কখনো কখনো ...
আরো পড়ুন
পথের পাঁচালি বিভুতিভুষণের প্রথম বই। যেই বইটি লেখার পরই রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে গেছেন। যার মাধ্যমেই ইছামতি, আরণ্যক, চাঁদের পাহাড়ের মতো বই বিখ্যাত হয়ে এসেছে।
পথের পাঁচালি এমন একটি উপন্যাস যেটা পড়লে মনেই হবে না আপনি বই পড়ছেন। বরং আপনার মনে হবে এই তো অপু-দুর্গার মতো আপনিও বাঁশবনে কখনো কখনো শিমুল তলায়, আবার কখনো সোনাডাঙ্গা মাঠে হেসে খেলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন।
পথের পাঁচালী বিভুতিভুষণের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। লেখকের অসম্ভব বর্ণনাশৈলী আমাকে উপন্যাসের আরো গভীরে নিয়ে গেছে। অপুদের ভাঙ্গা-চোরা ভিটের পাশে বাঁশবনে অপু-দুর্গার জীবনের প্রথম চড়ুইভাতি, কাশবনে ঘুড়ে বেরানো, আহা! মনে হয় যেন নিজের চোখে ভাসতেসে জ্বলজ্বল করে। কী গরিব,অসহায় তারা। দামী কোনো খাবার খেতে পারে না, বনের উচ্ছিষ্ট ফল বড় তৃপ্তি সহকারে খায়। মা সর্বজয়ার খুব কষ্ট হয় কিন্তু কি করবে এই এক ভিটে ছাড়া ঠায় যে নেই কোথাও। তারা যে খুব দরিদ্র এটা হারে হারে বুঝিয়ে দেয় তাদের প্রতিবেশিরা।হরিহর কাশি যায়, সর্বজয়ার মনে হয় এইবার উনি আসলেই একটা সুখের বার্তা নিয়ে আসবে। বলবে, অবস্থা ফিরিলো বলিয়া। কিন্তু হায়! দিন যায় মাস যায়, বছর চলে যায় সুখের দিন আর আসে না। দারিদ্র্য যে হতদরিদ্রকে আরো কাবু করে ফেলে সেটা পথের পাঁচালী তে খুব সুন্দর করে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পড়তে পড়তে কখনো মনে হয়েছে মানুষের জীবন এমনও হয়? জীবন যুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতেছে। গভীর মমতায় তাদের জন্য বুক ভরে ওঠে।
পথের পাঁচালী একটি সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের নাটকীয়তা শুরু হয় হরিহরের বাসায় ইন্দির ঠাকুরনের আগমনের ফলে। ইন্দির ঠাকুরন বিধবা, অনাথ এক মহিলা। যার দেখার কেউ ছিলো না। ইন্দির ঠাকুরনকে অল্প বয়সে এমনই এক লোকের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়, যে যৌতুকের লোভে অনত্র চলে যায় আর কখনো ফিরে আসে না। তখন আশ্রয় হয় পিতার বাড়িতে এবং তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর দূর সম্পর্কের আত্নীয় হরিহরের বাসায় ঠায় মিলে। সর্বজয়ার সাথে ইন্দির ঠাকুরনের সম্পর্ক মানবিক ছিলো না। উঠতে বসতে মনে করিয়ে দিতো সে যে একজন আশ্রিতা। ঝগড়া বিবাদ করে পুটুলি হাতে নিয়ে সে প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত, দিনশেষে তার পথ শেষ হয়ে আসতো হরিহরের বাড়িতেই। সামান্য কারণে তাকে কুঁড়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। ঠায় হয় চালের গুদামে। অসহায় বৃদ্ধা তার মৃত্যু-মুহুর্তে আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে তবুও সর্বজয়ার মন গলে না হৃদয়হীনভাবে না করে দেয়। শেষমেশ চালের গুদামেই সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে। ইন্দির ঠাকুরনের সাথে সর্বজয়ার যে ব্যবহার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে একটু বেশিই হয়ে গেছে। থাক না বেচারী একটুই তো ঠায় চায়, সঙ্গ চায় তাদের। বৃদ্ধারও তো যে কেউ নেই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় তারা খুব গরীব। তাদের নিজেদেরই খাবারের পয়সা থাকে না, আরেকজনের বাগানে, বাঁশবনে যেয়ে কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার সংগ্রহ করে খায়। তার উপর মানুষের দেওয়া কষ্টে জীবন বিপন্ন হয়ে গেছে, নিজেদেরই চলতে কষ্ট তার উপর আরেকজন আসলে বলতে হয় মরার উপর খরার ঘা।
দুর্গা ও অপু দুজনেই গ্রাম্য প্রকৃতি ভালোবাসে, রেলপথ তাদের কাছে এক রহস্যজগতের বার্তা পৌছে দেয়। নতুন নতুন অভিযানে দুর্গা হয় অপুর পথপ্রদর্শক। কিন্তু অপুর মধ্যে প্রকৃতির প্রতি যে মোহ, যে প্রেম, যে অনুভূতির প্রখরতা এবং ভাবুকতা তা দুর্গার মধ্যে ছিলো না। তবুও কেউ কারো থেকে কম না। এই উপন্যাসে অপুকে যদি প্রকৃতি-পুত্র বলতে হয় তাহলে দুর্গাকেও প্রকৃতি-কন্যা বলতে দ্বীধা নেই। দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনে বড় রকমের আঘাত আনে। দুর্গার উপর যে চুরির অভিযোগ ওঠে সেই চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্য অপু পুকুর পাড়ে গিয়ে স্বর্ণের লকেটটা জোরে একেবারে মাঝপুকুরে ফেলে দেয়, তৎক্ষণাৎ বুদবুদ করে দ্রব্যটি পানিতে তলিয়ে যায়। অপু নিশ্চিন্ত হয় যে আর কোনোদিন দিদির উপর ওপর কেউ চুরির প্রমাণটা কেউ খুঁজে পাবে না।
দুর্গার মৃত্যুর পর হরিহরের জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। জীবিকা নির্বাহের জন্য সংগ্রাম করে যেতে হয়। সেই সংগ্রামে যুক্ত হয় নিশ্চিন্দিপুর ছাড়ার। নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অপুর মনে হয়েছে দুর্গা মারা গেলেও দুজনের খেলা করার পথে-ঘাটে, বাঁশবনে, আমতলায় তাদের যে স্মৃতি সেটা বয়ে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আজীবন।নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ঘটে আরেকটি দুর্ঘটনা। তখন সর্বজয়ার চোখের অশ্রু মুছার জন্যও কেউ ছিলো না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়।কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। একমাত্র ভরসা ছিলো অপু। সেই অপুকেও অপদস্তের শিকার হতে হয় দারিদ্রতার জন্য। সে কথা জানায় অপুকেও। এরপর? এরপর কি হবে? তারা কি যেতে পারবে নিশ্চিন্দিপুরে? নিজের ভিটেটায় যেয়ে তাদের আশ্রয় হবে? জানতে হলে পড়তে হবে "পথের পাঁচালী"র পরের অংশ "অপরাজিত" যা অপুর সংসার নামে বিবেচিত।
কম দেখান